তোমরা অনেক মজার মজার গল্প জানো নিশ্চয়ই। কেউ কেউ হয়তো ভূতপ্রেতের কিসসা জানো। আবার কেউ বা জানো রাজা-রাজড়াদের গল্প। এমন অনেক গল্প আছে যা অনেক পুরনো দিনের। কিন্তু সেইসব গল্প শুনলে তোমরা চমকে উঠবে। তোমরা অনেক কিছু জানতে পারবে। এসব গল্পে হয়তো হাসাহাসির খোরাক নেই। নেই রমরমা কোনো ভয়ের বিষয়। তবে এসব গল্প শুনলে তোমরা হয়তো ভাববে, এসব ঘটনাও কি আসলে সম্ভব। মানুষ কি এমন হতে পারে! কিংবা মানুষের পক্ষে এমন করা আদৌ কি সম্ভব। এসব কাহিনী শুনে তোমরা অবাক হয়ে যাবে। আজ এমনই এক কাহিনী তোমাদের শোনাব।
সে অনেক অনেক দিন আগের কথা। এক ছিল মস্তবড় রাজা। তার ছিল বিশাল বড় এক রাজ্য। এত বড় রাজ্য তখন কোথাও ছিল না। আজো এত বড় রাজ্য দুনিয়ার মানুষ দেখেনি। অথচ সেই রাজার ছিল অতি সাধারণ এক রাজপ্রাসাদ। সেই প্রাসাদে কোনো জাঁকজমক ছিল না। রাজপ্রাসাদের সিংহদরজায় ছিল না কোনো পাহারাদার। রাজার নিরাপত্তার জন্য কোনো সৈন্যসামন্ত ছিল না। সেই রাজপ্রাসাদ উজির-নাজিরদের ভিড়ে গমগম করত না। রাজার প্রাসাদে দাসদাসীদের কলরবও শোনা যেত না। রাতের বেলায় নানা রঙের বাতির মহড়াও চোখে পড়ত না রাজপ্রাসাদে। আর রাজার অবস্থা তো ছিল আরো করুণ। তাকে দেখলে কে বুঝবে যে তিনি এত বিশাল রাজ্যের মালিক। তার গায়ে জরির পোশাক নেই। মাথায় স্বর্ণের মুকুটও নেই। রাজার পায়ে সোনালি নাগরাও নেই। রাজা যখন চলেন তার আগে-পিছে শত শত সৈন্যসামন্ত বা দাসদাসীর লটবহর দেখা যেত না। সেই এক অদ্ভুত রাজা ছিলেন তিনি। আর অদ্ভুত ধরনের ছিল তার রাজপ্রাসাদ। আমাদের অতিপরিচিত এই রাজা ছিলেন এক গরিব রাজা। গরিব হলে কী হবে, রাজার ছিল দুনিয়াজোড়া নাম। তার ছিল বিশাল রাজ্য। তার ক্ষমতাও ছিল অসীম। তার নাম শুনলেই আশপাশের বড় বড় রাজা ভয়ে থরথর করে কাঁপত। তার রাজ্যে কোনো অভাব-অনটন ছিল না। রাজ্যের মানুষ সুখশান্তিতে বাস করত। সেই রাজ্যে উঁচু-নীচুর কোনো ভেদাভেদ ছিল না। রাজার রাজ্যে হানাহানি-দলাদলি ছিল না। সবাই মিলেমিশে বাস করত তার রাজ্যে। সেই রাজ্যের মানুষ সদাই হাসিখুশিতে দিন কাটাত। রাজাও ছিল বড় সচেতন। তার দেশের কোনো মানুষ না খেয়ে না পরে থাকুক সেটা রাজা চিন্তাও করতে পারত না। তাই সে রাতের আঁধারে ঘুরে বেড়াত মানুষের দ্বারে দ্বারে। কে কোথায় কিভাবে আছে, তাদের অবস্থা নিজ চোখে দেখার জন্য সে ব্যাকুল থাকত। সবাই যখন ঘুমিয়ে পড়ত গরিব রাজা ঠিক তখনই বেরিয়ে পড়ত তার প্রজাদের খোঁজে। সে বলত, আমার রাজ্যে একটি কুকুরও যদি না খেয়ে মারা যায় তাহলে এর জন্য আমাকেই মহান প্রভুর কাছে জবাবদিহি করতে হবে। কেমন অপূর্ব মহৎ ও দরদি ছিল সেই রাজা।
একদিনের ঘটনা। রাজা আপন মনে ঘুরে বেড়াচ্ছিল মদিনার অলিগলিতে। চার দিকে তখন ঘন অন্ধকার। মদিনার মানুষেরা সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে। কোথাও কোনো সাড়াশব্দ নেই। রাজা ঘুরতে ঘুরতে এক জায়গায় এসে দেখল অনতিদূরে ক্ষীণ আলো জ্বলছে। রাজা বুঝল কেউ হয়তো জেগে আছে। তার মনে অজানা এক বিপদের আশঙ্কা জাগল। তাই সে এগিয়ে গেল। সামনে এগোতেই রাজার চোখে পড়ল একটি তাঁবু। সে আরো কাছে গেলে বাইরে থেকে এক দৃশ্য দেখে রাজার মন খারাপ হয়ে গেল। সে দেখল এক মহিলা উনুনে পানি জ্বাল দিচ্ছে আর পাশে বসে তার ছোট ছোট ছেলেমেয়ে কাঁদছে। রাজা অনেকক্ষণ একই দৃশ্য দেখে অবাক হলো। তাই সে কাছে এগিয়ে গিয়ে মহিলাকে পানি জ্বাল দেয়ার কারণ জিজ্ঞেস করল। মহিলা লোকটির কথা শুনে অশ্রুসজল হয়ে উঠল। তার বাকরুদ্ধ হয়ে গেল। তারপর অনেক কষ্টে মহিলা বলল, ‘আমার ঘরে কোনো খাবার নেই। ছেলেমেয়েরা না খেয়ে আছে। ুধার জ্বালায় কাঁদছে। তাই তাদের মিথ্যা বুঝ দেয়ার জন্য খালি হাঁড়িতে মিছেমিছি পানি জ্বাল দিচ্ছি।’
মহিলার দুঃখের কথা শুনে রাজার মন বিষাদে ভরে উঠল। সে এই অবুঝ শিশুদের ব্যথা দেখে মর্মাহত হলো। তৎক্ষণাৎ রাজা মহিলাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলল, একটু অপেক্ষা করো মা, আমি এক্ষনি আসছি। এ কথা বলেই সে বেরিয়ে পড়ল। একটু পরই বায়তুলমাল থেকে খাবারের বোঝা নিজের পিঠে বহন করে মহিলার তাঁবুতে পৌঁছে দিলো। মহিলা এগুলো দিয়ে খাবার তৈরি করে ুধার্ত ছেলেমেয়েদের খাওয়াল। এতে মহিলা খুবই খুশি হলো। এই অবস্থা দেখে রাজার মনও পরম তৃপ্তিতে ভরে উঠল। মহিলার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে এবার রাজা গভীর রাতে রাজপ্রসাদে ফিরে গেল। প্রজার সেবা করতে পেরে সে প্রভুর শুকরিয়া আদায় করল।
এই মহান রাজার জীবনের আর একটি ঘটনা। একদিন তার বেগম তাকে বলল, বহুদিন ধরে জয়তুন তেল দিয়ে শুকনো রুটি খেতে খেতে মুখে একদম অরুচি ধরে গেছে। যদি একটু মধুর ব্যবস্থা করা যেত তাহলে মন্দ হতো না। রাজা বেগমের কথা শুনে ভাবল। সেও যে এ রকমই চিন্তা করছিল। কিন্তু মধু আনার সামর্থ্য যে তার নেই। যা ভাতা পায় তা দিয়ে মধু জোগাড় করা খুব কটিন। বহু ভেবে বেগম একটা উপায় বের করল। সে বলল, বায়তুলমাল থেকে কিছু দিরহাম ধার নিলেই তো হয়ে যায়। পরে তা ধীরে ধীরে শোধ করার ব্যবস্থা করা যায়। বেগমের কথা রাজার মনঃপূত হলো। তাই সে বায়তুলমালের প্রধানের কাছে যাওয়ার জন্য মনস্থ করল। এমন সময় রাজার পুত্র বলল, বাবা! আপনি কি মনে করেন যে আপনি আগামীকাল পর্যন্ত বেঁচে থাকবেন?
রাজা জবাব দিলো, মানুষের তো এক মুহূর্তও বেঁচে থাকার সুযোগ নেই।
এবার পুত্র বলল, তাহলে আপনার ঋণ করে ভালো খাবার জোগাড় করা কি ঠিক হবে? এ কথা শুনে রাজার মন কেঁপে উঠল। তাই তার আর মধু খাওয়া হলো না। এই মহান লোকটির নাম কি তোমরা অনুমান করতে পারো? এত সহজ-সরল, খোদাভীরু ও প্রজাবৎসল রাজার কথা কি কল্পনা করা যায়! অথচ তিনি অর্ধেক দুনিয়ার মালিক। এই মহারাজা আর কেউ নন, ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হজরত উমর রা:। তিনি উমর ইবনে খাত্তাব। তার শাসনব্যবস্থার নজির আজো বিরল। উমরের রা: শাসনের মতো সুন্দর ও শান্তিময় অবস্থা আজো দুনিয়ায় কায়েম হয়নি। এই মহান ব্যক্তির জীবনে এ রকম আরো অনেক অনুপম ও শিক্ষণীয় ঘটনায় পরিপূর্ণ। তোমরা বড় হয়ে তার বিশাল জীবনচরিত পড়লে আরো অনেক কিছুই জানতে পারবে। তিনি ৫৮৩ খ্রিষ্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ১০ বছর ছয় মাস ক্ষমতায় ছিলেন। হিজরি ২৩ সালে এই মহান ব্যক্তি ইন্তেকাল করেন।
No comments:
Post a Comment