Tuesday, 21 May 2013

স্বাস্থ্য ও মানবদেহ

খাটো দৃষ্টি দূরীকরনে বহির্মূখী কর্মকান্ড ও অবস্থান
মানব দেহের সবচেয়ে স্পর্শকাতর একটি অংশ চোখ। বিভিন্ন সময় চোখের বিভিন্ন ধরনের সমস্যা দেখা যায়। চোখের দৃষ্টি জনিত সমস্যা প্রধানত ৪ ধরনের। এই ত্রুটি গুলো হলোঃ ক্ষীন দৃষ্টি ত্রুটি, দূর দৃষ্টি ত্রুটি, বার্ধক্য দৃষ্টি ত্রুটি, বিষম দৃষ্টি ত্রুটি। এর মাঝে প্রথম ২ ধরনের সমস্যাই প্রধান এবং এই সমস্যা গুলোরই বেশি মূখোমূখী হয়ে থাকি। আজকে আমরা যে সমস্যা নিয়ে আলোকপাত করবো সেটা হল ক্ষীন দৃষ্টি ত্রুটি ।

ক্ষীন দৃষ্টি ত্রুটিঃ
এ সমস্যার কারনে ব্যাক্তি চোখের কাছে বস্তু গুলো ঠিক দেখতে পায় কিন্তু দূরবর্তী বস্তু দেখতে পায় না বা অষ্পষ্ট দেখে। এই ত্রুটিকে মাইয়োপিয়া বা ক্ষীন দৃষ্টি বলে। শিশুদের বা কম বয়সীদের এই সমস্যা বেশি দেখা যায়।
সমাধান/প্রতিকারঃ
বাইরে খেলাধুলা করা ছোট ছেলে মেয়েদের একটা উত্তম বিনোদনের একটি। এবং পরিসংখ্যান বলছে বাইরে সময় কাটানো চোখের জন্য উপকারী। কারন সৌর রশ্মি এই মাইয়োপিয়া রোধে বেশ কার্যকর। তাই জরিপ পরামর্শ দেয় যে ঘরের বাইরে যত টুকু সময় দেওওয়া যায় সেটাই উত্তম। তবে এক্ষেত্রে শিশুদের জন্য দৈনিক ১ থেকে দেড়ঘন্টা করে সপ্তাহে কমপক্ষে ১০-১৪ ঘন্টা বাইরে খেলাধুলায় সময় দেওয়া উচিত।
মাইয়োপিয়া বা ক্ষীনদৃষ্টির এই জটিল অসুখ পরিবেশ কিংবা জেনেটিক (বংশিয়) অথবা উভয় কারনেই হতে পারে। তবে এক্ষেত্রে সৌর আলো এক্ষেত্রে চশমা ব্যবহার যাদুর মত রুখবে তা বলা যায়না। তবে এই সৌর আলকের পরামর্শ এক দিক দিয়ে ভালোই হল আপনার ও আপনার শিশুর জন্য, খেলা দুলা বাড়বে শরীর ও ফ্রেশ ও প্রানোচ্ছল থাকবে এটাই বা কম কি ?


খালি পায়ে হাটা স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী

খালি পায়ে হাটা ও দৌড়ানো অনেক ক্ষেত্রেই জুতা পরে হাটার চেয়ে বেশি উপকারী। পায়ের বেশ কিছু রোগের জন্য আমেরিকার বিশেষজ্ঞ দল জুতা পরে হাটাকেই দায়ী করেছেন। হার্ভাট বিশ্ববিদ্যালয়ের ইরানী ডেভিস মূলতঃ মানুষের চলাফেরা এবং এর উপরে বর্তমান সময়ের জুতাগুলো স্বাস্থ্যসম্মত কিনা তা গবেষণা করছেন।
pavement pounders prone সহ বেশ কিছু রোগের জন্য নিয়মিত জুতা পরে দৌড়ানোকেই দায়ী করেছেন- চিকিৎসকগণ।
barefoot-415x539
তিনি জানান,
“যখন আপনি হিলওয়ালা জুতা পরে দ্রুত দৌড়ান তখন পায়ের একটি অংশে শরীরের সম্পূর্ণ ভর দেওয়া হয়, এবং অন্য অংশে কোন চাপ পরে না। এবং যদি খালি পায়ে হাটা হয় তখন সম্পূর্ণ পায়ে-ই একটা ভারসাম্য বজায় থাকে। “
এই বেপারে পর্যবেক্ষণের জন্য কেনিয়ার রানারদের উপরে পরীক্ষা চালানো হয়। তাদেরকের জুতা পরে  নিয়মিত দৌড়ানোর পরে খালি পায়ে দৌড়াতে দিলে তাদের পায়ে একটি ব্যথা অনুভব হয়। জুতা পরে দৌড়ালে চলাফেরার জন্য আলাদা একটি প্যাটার্ণ তৈরী হয়। মাংশপেশীগুলোও সেই ভাবে সংকুচিত এবং প্রসারিত হয়। কিন্তু খালি পায়ে হাটলে সেই মাংশপেশীতে আবার টান পরে এবং তাই ব্যথা অনুভব হয়।
এজন্য অবশ্য এমন ধরনের জুতা বানানো যেতে পারে যার মাধ্যমে পায়ের স্বাভাবিকতা বজায় থাকবে এবং পায়ের সাধারন চরাফেরায় ব্যঘাত হবে না।



ভালবাসার বিপদঃ ব্রোকেন হার্ট সিনড্রোম

বর্তমানে “হৃদয় জোড়া লাগা” ঘটনার প্রবল জোয়াড় চললেও “হৃদয় ভাঙা” ঘটনার স্বাভাবিক স্রোতটুকুও দেখা যায় না। এর কারণ হয়ত সত্যিকারের ভালবাসার ঘটনা আজকাল আর তেমন ঘটে না বলেই। তবে একদমই যে ঘটে না তাও না। আজও অনেকে সত্যিকারের ভালবাসার ফাঁদে পরেন এবং এর কারণে অনেকেরই হৃদয় ভেঙে চুরমার হয়ে যায়, যার কারণে তারা ভুগতে শুরু করেন ভাঙা হৃদয় সিনড্রোম বা Broken heart syndrom থেকে ।
broken_heart_by_starry_eyedkid-1এরই মধ্যেই অনেকে নিশ্চয় ধরে ফেলেছেন যে এটি  প্রেমঘটিত (সাধারণত) এরং হৃদয়ঘটিত এক ধরণের Medical Condition যার সংজ্ঞা অনেকটা এরকম -
“Broken Heart Syndrome হল এমন এক ধরণের Medical Condition, যেখানে আকস্মিক মানসিকভাবে চরম আঘাত পাওয়ার কারণে হৃদপিন্ডের  মাংসপেশী myocardium  সাময়িকভাবে দূর্বল হয়ে পরে এরং এর কারণে  শারিরীকভাবে বুকে  ব্যাথা অনুভূত হয়।”
আরও ভাল করে বলা যায় -
“Broken Heart Syndrome is such an Medical Condition which is triggered by extreme and sudden emotional trauma  and due to which there is a temporary weakening of the myocardium (the muscle of the heart).”
এবার একটু details এ আসা যাক।
পূর্বে ধারণা করা হত যারা Broken Heart Syndrome বা BHS এ ভুগে, তারা হয়ত বড় রকমের হার্ট এ্যটাকের (Heart Attack) স্বীকার হচ্ছে। কারণ  BHS এমনই চালাক যে এটা ঠিক Heart Attack  এর  symptoms বা লক্ষণগুলোর মত লক্ষণ প্রকাশ করে থাকে, যেমন – বুকে ব্যাথা হওয়া, শ্বাস-প্রশ্বাসে স্বল্পতা, প্রবলভাবে ঘেমে যাওয়া ইত্যাদি। পরবর্তীতে বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে ডাক্তারেরা নিশ্চিত হন যে এটা কোন হার্ট এ্যটাকের নয়,  হার্ট এ্যটাকের এর ভেলকি মাত্র। শুদ্ধ বাংলায় এটাকে হয়ত  মজা করে আমরা ”হৃদয়ের লীলা খেলা” বলতে পারি ।
Broken Heart Syndrome (BHS) আরও বিভিন্ন নামে পরিচিত,  যেমন – Takotsubo cardiomyopathy , Gebrochenes-Herz-Syndrom ইত্যাদি তবে stress cardiomyopathy নামটি বেশি প্রযোজ্য।
BHS প্রথম আবিষ্কার করেন জাপানী ডাক্তারেরা ১৯৯১ সালে। তারাই  এটার নাম দিয়েছিলেন Takotsubo cardiomyopathy বা octopus trap cardiomyopathy ।  যদিও এখন পর্যন্ত এর সঠিক কারণটি জানা যায়নি, তবে ধারণা করা হয়  আকস্মিক মানসিকভাবে চরম আঘাত পাওয়ার কারণে, শরীরের stress hormones-গুলোর (যেমন – adrenaline ) অস্বাভাবিক প্রতিক্রিয়ায় এমনটি হয়। এখানে  মানসিকভাবে আঘাত পাওয়া বলতে প্রেমিক-প্রেমিকার সাথে ছাড়াছাড়ি হয়ে যাওয়া, প্রিয় কাউকে হারিয়ে ফেলা ইত্যাদি ঘটনায় মানসিকভাবে আঘাত পাওয়াকেই সাধারণত বুঝিয়ে থাকে। এছাড়া ভয়াবহ কোন দু:সংবাদ শুনেও এমন হতে পারে।
যাই হোক সুসংবাদ হল যে BHS নকল হার্ট এ্যটাকের মাত্র এবং এটা থেকে ১০০% ভাগ সুস্থ হওয়া সম্ভব ।
পরিশেষে এটাই বলব যে Broken Heart Syndrome এর ভয়ে ভালবাসা থেকে দূরে থাকা হবে চূড়ান্ত রকমের বোকামি কারণ -
“Life is the flower of which love is the honey. ”
–Jean Baptiste Alphonse Karr
পুনশ্চ: পুরুষদের তুলনায় নারীরা Broken Heart Syndrome -এ বেশি ভোগে ( নারীরা একটু বেশিই ইমোশোনাল কিনা!  No offence! )।


আপনি জানেন কীঃ ক্যালসিয়াম ওজন কমায়!

 আমি শুনেছি জ্ঞান কখনো বৃথা যায় না। আর এটা এমন না যে ছোটরা বড়দের চেয়ে সবদিক থেকে কম জানে।

ক্যালসিয়াম এমন একটা মিনারেল যা শরীরের চর্বি কমিয়ে ওজনটাকেও কমিয়ে দেয়। সম্প্রতি বিষয়টি নিয়ে বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়েছে পারাভিউ ইউনিভার্সিটির গবেষকগণ। বেশ কিছু সংখ্যক মহিলাদের নিয়ে এ পরীক্ষাটি চালানো হয়েছে। গবেষকগণ তাদেরকে বেশি বেশি করে ক্যালসিয়াম সমৃদ্ধি খাবার খাইয়েছেন। অপর আরেকদল মহিলাদেরকে গবেষকগণ স্বাভাবিক খাবার খাইয়েছেন। দেখা গেছে যারা বেশি করে ক্যালসিয়াম খেয়েছেন তাদের ওজন কমেছে বাকিদের তুলনায়।
এদিকে ক্যালসিয়াম কিভাবে ওজন কমায় তা নিয়ে বিজ্ঞানী-গবেষকগণ একটা নতুন তথ্যও দাঁড় করিয়েছেন। তাদের ভাষ্যমতে ক্যালসিয়ামের অভাব হলে রক্তে প্যারাথাইয়েড হরমোনের মাত্রা বেড়ে যায়। এটি একই সাথে রক্তে এ্যাকটিভ ভিটামিন-ডি এর মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। এই প্যারাথাইয়েড হরমোন এবং ভিটামিন ডি ফ্যাট সেলগুলোতে ক্যালসিয়ামের অনুপ্রবেশ ঘটায় এবং ফ্যাটসেল গুলোতে আরো ফ্যাট জমা হতে সাহায্য করে। ফলে শরীরে ফ্যাট জমে ওজন বেড়ে যায়।
অপরদিকে রক্তে ক্যালসিয়ামের মাত্রা বেশি থাকলে এই দৃশ্যপট বদলে যায়। ফলে ফ্যাট ভাঙ্গতে শুরু করে আর ফ্যাটের স্টোরও কমে যায়। ফলে ওজনও কমে যায়।
সুতরাং ওজন কমাতে হলে এখন থেকেই বেশি বেশি করে ক্যালসিয়াম যুক্ত খাবার খাওয়া শুরু করুন। থাকুন ফ্যাট ফ্রী, উড়ে বেড়ান মুক্ত বাতাসে :)



কোমল পানীয় পান করার ক্ষতিসমূহ এবং যা করা উচিত

 কোমল পানীয় পছন্দ করেন এমন কয় জন আছেন? হাত তোলেন! ;) দেখবেন ১০ জনের মধ্যে ৮ জনই হাত তুলবে। হ্যা এটাই স্বাভাবিক। বাজারে হাতের নাগালেই পেয়ে যাবেন নাম জানা – অজানা নানান কোমল পানীয় অর্থাৎ যাকে আমরা আদর করে ডাকি এনার্জি ড্রিকংস। আমরা অনেকেই জানি না যে এই সব এনার্জি ড্রিকংস গুলোতে আসলে কি থাকে। তবে খেতে অবশ্য বেশ মজা পাই। কারণ কোমল পানীয় গুলো আসলে খেতে ভারি মজাদার। কিন্তু প্রশ্ন হলো, নাম কোমল পানীয় হলেও তা কি সত্যি আমাদের দেহের জন্য কোমলীয়? নাহ একদম না। কোমল পানীয় আমাদের দেহের জন্য মারাত্তক ক্ষতি কর। মুলত কোমল পানিতে আছে ফসফরিক এসিড, ক্যাফেইন, সুগার, কার্বন ডাই অক্সাইড, অ্যালুমিনিয়াম ইত্যাদি। যা মুলত আমাদের দেহের ক্ষতি করার পাশা পাশি কোলেস্ট্রল মানে অতিরিক্ত মেদ বাড়িয়ে দেয়। সহজ কথায় আমাদের শরীরের ওজন বৃদ্ধি করে। যাই হোক আজ আমি আপনাদের সামনে এই কোমল পানীয়র কিছু বিশেষ ক্ষতিকর বিষয়গুলো তুলে ধরবো।

ক্ষতিকর দিক সমূহঃ

  • দুধ, ভিটামিন ডি, বি৬, বি১২, ক্যালসিয়ামের শোষণ হ্রাস পায়। যার ফলে হাড়ের ঘনত্ব কমে।
  • দাঁতের এনামেল নষ্ট হয়। ক্যাবিজের ঝুঁকি বৃদ্ধি পায়।
  • দেহে কোলেস্ট্রল বৃদ্ধি করে মানে শরীরের ওজন বাড়ায়। ক্ষুদা মন্দা সৃষ্টি করে এবং অতিরিক্ত পানে তা বৃদ্ধি পেতে থাকে।
  • কোমল পানীয় অ্যাসিডিক, তাই অ্যাসিডিটি বাড়ায়।
  • কিডনিতে পাথর হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
  • চামড়ায় ভাঁজের সৃষ্টি হয়। ফলে চেহারায় বয়সের ছাপ পড়ে।

যা করা উচিতঃ

  • যতদুর সম্ভব কোমল পানীয় পান করা থেকে নিজেকে বিরত রাখুন।
  • যদি পান করা থেকে বিরত না থাকতে পারেন তাহলে নিয়মিত নয়, মাঝে মাঝে (২০০-২৫০ মিলি) পান করতে পারেন।
  • খালি পেটে কখনোই পান করবেন না।
  • ক্ষার জাতীয় খাবার খাওয়ার পর পান করুন।
  • কোমল পানীয় পান করার সময় স্ট্র ব্যবহার করুন।
  • পান করার পর ব্রাস করে নিতে ভুলবেন না যেন

 

ব্যায়ামের জানা-অজানা উপকারীতা

আমরা সবাই বলি ব্যায়াম বা শরীরচর্চা করা উপকারী। কিন্তু কতটুকু উপকারী, তা অনেকেই জানি না। নিয়মিত ব্যায়াম করলে নানা রকম দীর্ঘ মেয়াদী রোগব্যাধি থেকে মুক্ত থাকা যায়, ওজন কমানো যায়, ভালো ঘুম হয় আর মানসিক প্রশান্তি আসে।

নিচে ব্যায়াম করার বেশ কিছু উপকারীতা আপনাদের সাথে শেয়ার করলামঃ

ব্যায়াম মনকে চাঙ্গা করেঃ

ব্যায়াম করলে মস্তিস্ক থেকে নানা রকম রাসয়নিক পদার্থ নির্গত হয়। এসব রাসায়নিক উপাদান চিত্ত প্রফুল্ল করে এবং শারীরিক ও মানসিক প্রশান্তির পাশাপাশি চেহারায় লাবণ্য ও ওজ্জ্বল্য বাড়ায়। যিনি নিয়মিত ব্যায়াম করেন তাকে বিষন্নতা কিংবা হতাশা সহজে হ্রাস করতে পারে না।

রোগ প্রতিরোধ করেঃ

আধুনিক জীবনে শারীরিক পরিশ্রমের পরিমান কমে গিয়েছে, অর্থাৎ হাটাহাটির প্রয়োজন হয় না বললেই চলে আর আমাদের খাদ্যাভ্যাসও বদলে গিয়েছে। ফলে দিনে দিনে ক্রনিক রোগ ব্যাধি যেমনঃ হৃদরোগ, ডায়াবেটিস, উচ্চরক্তচাপ, অস্থিক্ষয়, ক্যানসার ইত্যাদি প্রকোপ বহুগুণে বেড়েছে। নিয়মিত ব্যায়াম এগুলো প্রতিরোধ করে।

শরীরের বাড়তি ওজন কমায়ঃ

বাড়তি ওজন কমাতে ব্যায়ামের কোন বিকল্প নেই। শারীরিক চর্চা করলে ক্যালরি খরচ হয়। এভাবে আমরা যতই ব্যায়াম করবো ততই আমাদের ক্যালরী খরচ হবে এবং যার ফলে শরীরের ওজন নিয়ন্ত্রনে থাকবে।

কর্মস্পৃহা বাড়ায়ঃ

ব্যায়ামের ফলে আমাদের শরীরের প্রতিটি কোষে অতিরিক্ত অক্সিজেন ও পুষ্টি সরবারাহ হয়। এর ফলে আমাদের হৃদযন্ত্র ও রক্তলালি সচল থাকে। এর ফলে সমস্ত শরীরে একটি সুস্থ প্রাণস্পন্দন ও উদ্দীপনা সৃষ্টি হয়। এটা আমাদের কর্মস্পৃহা বাড়ায়।

সুনিন্দ্রা আনেঃ

যাদের ঘুমের সমস্যা আছে তাদের জন্য ব্যায়াম অত্যান্ত উপকারী। ব্যায়াম অনিন্দ্র দুর করে, অতি নিদ্রা হ্রাস করে। অবশ্য একেবারে ঘুমানোর আগে ব্যায়াম করা উচিত নয়। কারণ ব্যায়ামের পরে মানসিক চাঙা ভাবের কারণে ঘুম আসা বিলম্বিত হতে পারে।

যৌন জীবনের জন্য উপকারীঃ

যাদের যৌনজীবনে জড়তা কিংবা অনাগ্রহ এসেছে, তাদের জন্য ব্যায়াম অত্যান্ত উপকারী। নিয়মিত ব্যায়াম করলে যৌনস্পৃহা বাড়ে, যৌন মিলনের স্থায়ীত্বকাল বৃদ্ধি পায় এবং দাম্পত্য জীবনে ইতিবাচক পরিবর্তন আনে।

ব্যায়ামের বিকল্পঃ

যদি আপনি নিয়মিত ব্যায়াম করার সময় না পান তাহলে নিয়মিত সালাত আদায় করুন। কারণ আমার জানা মতে, ব্যায়াম থেকে যে সব উপকারীতা পাওয়া যায় তার থেকে বেশী উপকারীতা পাওয়া যায় নিয়মিত সালাত আদায় করলে। আর তাছাড়া প্রত্যেক মুসলাম নর-নারীর উপর সালাত ফরজ।
সুতরাং বুঝায়ই যাচ্ছে যে সুস্থ দেহ ও মনের বিকাশের জন্য নিয়মিত ব্যায়াম কতখানি গুরুত্বপূর্ণ। তাই আসুন নিয়মিত সালাত আদায় করি এবং ব্যায়াম করি।

Monday, 20 May 2013

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর-এর কবিতা




আমার মিলন লাগি তুমি

আমার মিলন লাগি তুমি
আসছ কবে থেকে।
তোমার চন্দ্র সূর্য তোমায়
রাখবে কোথায় ঢেকে। 

কত কালের সকাল-সাঁঝে 

তোমার চরণধ্বনি বাজে, 

গোপনে দূত গৃহ-মাঝে
গেছে আমায় ডেকে।
ওগো পথিক, আজকে আমার
সকল পরাণ ব্যেপে
থেকে থেকে হরষ যেন
উঠছে কেঁপে কেঁপে 

যেন সময় এসেছে আজ,

ফুরালো মোর যা ছিল কাজ -

বাতাস আসে, হে মহারাজ,

তোমার গন্ধ মেখে। 

আমি চেয়ে আছি

আমি চেয়ে আছি তোমাদের সবা-পানে।
স্থান দাও মোরে সকলের মাঝখানে।
নীচে সব-নীচে এ ধূলির ধরণীতে
যেথা আসনের মূল্য না হয় দিতে,
যেথা রেখা দিয়ে ভাগ করা নাই কিছু,
       যেথা ভেদ নাই মানে আর অপমানে।
       স্থান দাও সেথা সকলের মাঝখানে।

যেথা বাহিরের আবরণ নাহি রয়,
যেথা আপনার উলঙ্গ পরিচয়।
আমার বলিয়া কিছু নাই একেবারে
এ সত্য যেথা নাহি ঢাকে আপনারে,
সেথায় দাঁড়ায়ে নিলাজ দৈন্য মম
       ভরিয়া লইব তাঁহার পরম দানে।
       স্থান দাও মোরে সকলের মাঝখানে। 





বীরপুরুষ

মনে করো যেন বিদেশ ঘুরে
     মাকে নিয়ে যাচ্ছি অনেক দূরে ।
তুমি যাচ্ছ পালকিতে মা চড়ে
দরজা দুটো একটুকু ফাঁক করে,
আমি যাচ্ছি রাঙা ঘোড়ার ’পরে
     টগবগিয়ে তোমার পাশে পাশে ।
রাস্তা থেকে ঘোড়ার খুরে খুরে
     রাঙা ধুলোয় মেঘ উড়িয়ে আসে ।

     সন্ধে হল,সূর্য নামে পাটে
     এলেম যেন জোড়াদিঘির মাঠে ।
ধূ ধূ করে যে দিক পানে চাই
কোনোখানে জনমানব নাই,
তুমি যেন আপনমনে তাই
     ভয় পেয়েছ; ভাবছ, এলেম কোথা?
আমি বলছি, ‘ভয় পেয়ো না মা গো,
     ঐ দেখা যায় মরা নদীর সোঁতা ।’

চোরকাঁটাতে মাঠ রয়েছে ঢেকে,
    মাঝখানেতে পথ গিয়েছে বেঁকে ।
গোরু বাছুর নেইকো কোনোখানে,
সন্ধে হতেই গেছে গাঁয়ের পানে,
আমরা কোথায় যাচ্ছি কে তা জানে,
     অন্ধকারে দেখা যায় না ভালো ।
তুমি যেন বললে আমায় ডেকে,
      ‘দিঘির ধারে ঐ যে কিসের আলো!’

     এমন সময় 'হারে রে রে রে রে’
     ঐ যে কারা আসতেছে ডাক ছেড়ে ।
তুমি ভয়ে পালকিতে এক কোণে
ঠাকুর দেবতা স্মরণ করছ মনে,
বেয়ারাগুলো পাশের কাঁটাবনে
     পালকি ছেড়ে কাঁপছে থরোথরো।
আমি যেন তোমায় বলছি ডেকে,
     ‘আমি আছি, ভয় কেন মা কর।’

হাতে লাঠি, মাথায় ঝাঁকড়া চুল
     কানে তাদের গোঁজা জবার ফুল ।
আমি বলি, ‘দাঁড়া, খবরদার!
এক পা আগে আসিস যদি আর -
এই চেয়ে দেখ আমার তলোয়ার,
     টুকরো করে দেব তোদের সেরে ।’
শুনে তারা লম্ফ দিয়ে উঠে
     চেঁচিয়ে উঠল, ‘হারে রে রে রে রে।’

     তুমি বললে, ‘যাস না খোকা ওরে’
     আমি বলি, ‘দেখো না চুপ করে।’
ছুটিয়ে ঘোড়া গেলেম তাদের মাঝে,
ঢাল তলোয়ার ঝন্‌ঝনিয়ে বাজে
কী ভয়ানক লড়াই হল মা যে,
     শুনে তোমার গায়ে দেবে কাঁটা।
কত লোক যে পালিয়ে গেল ভয়ে,
     কত লোকের মাথা পড়ল কাটা।

এত লোকের সঙ্গে লড়াই করে
     ভাবছ খোকা গেলই বুঝি মরে।
আমি তখন রক্ত মেখে ঘেমে
বলছি এসে, ‘লড়াই গেছে থেমে’,
তুমি শুনে পালকি থেকে নেমে
     চুমো খেয়ে নিচ্ছ আমায় কোলে -
বলছ, ‘ভাগ্যে খোকা সঙ্গে ছিল!
     কী দুর্দশাই হত তা না হলে।’

     রোজ কত কী ঘটে যাহা তাহা -
     এমন কেন সত্যি হয় না আহা।
ঠিক যেন এক গল্প হত তবে,
শুনত যারা অবাক হত সবে,
দাদা বলত, ‘কেমন করে হবে,
     খোকার গায়ে এত কি জোর আছে।’
পাড়ার লোকে বলত সবাই শুনে,
      ‘ভাগ্যে খোকা ছিল মায়ের কাছে।’

প্রার্থনা

চিত্ত যেথা ভয়শূণ্য, উচ্চ যেথা শির,
জ্ঞান যেথা মুক্ত, যেথা গৃহের প্রাচীর
আপন প্রাঙ্গণতলে দিবসশর্বরী
বসুধারে রাখে নাই খন্ড ক্ষুদ্র করি,
যেথা বাক্য হৃদয়ের উৎসমুখ হতে
উচ্ছ্বাসিয়া উঠে, যেথা নির্বারিত স্রোতে
দেশে দেশে দিশে দিশে কর্মধারা ধায়
অজস্র সহস্রবিধ চরিতার্থতায়,
যেথা তুচ্ছ আচারের মরুবালুরাশি
বিচারের স্রোতঃপথ ফেলে নাই গ্রাসি-
পৌরুষেরে করে নি শতধা, নিত্য যেথা
তুমি সর্ব কর্ম চিন্তা আনন্দের নেতা,
নিজ হস্তে নির্দয় আঘাত করি, পিতঃ,
ভারতেরে সেই স্বর্গে করো জাগরিত।।

প্রাণ

মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভুবনে,
মানবের মাঝে আমি বাঁচিবার চাই।
এই সূর্যকরে এই পুষ্পিত কাননে
জীবন্ত হৃদয়-মাঝে যদি স্থান পাই!
ধরায় প্রাণের খেলা চিরতরঙ্গিত,
বিরহ মিলন কত হাসি-অশ্রু-ময় -
মানবের সুখে দুঃখে গাঁথিয়া সংগীত
যদি গো রচিতে পারি অমর-আলয়!
তা যদি না পারি, তবে বাঁচি যত কাল
তোমাদেরি মাঝখানে লভি যেন ঠাঁই,
তোমরা তুলিবে বলে সকাল বিকাল
নব নব সংগীতের কুসুম ফুটাই।
হাসিমুখে নিয়া ফুল, তার পরে হায়
ফেলে দিয়ো ফুল, যদি সে ফুল শুকায়।। 





আমাদের ছোট নদী

আমাদের ছোটো নদী চলে বাঁকে বাঁকে
বৈশাখ মাসে তার হাঁটু জল থাকে।
পার হয়ে যায় গোরু, পার হয় গাড়ি,
দুই ধার উঁচু তার, ঢালু তার পাড়ি।

চিক্ চিক্ করে বালি, কোথা নাই কাদা,
একধারে কাশবন ফুলে ফুলে সাদা।
কিচিমিচি করে সেথা শালিকের ঝাঁক,
রাতে ওঠে থেকে থেকে শেয়ালের হাঁক।

আর-পারে আমবন তালবন চলে,
গাঁয়ের বামুন পাড়া তারি ছায়াতলে।
তীরে তীরে ছেলে মেয়ে নাইবার কালে
গামছায় জল ভরি গায়ে তারা ঢালে।

সকালে বিকালে কভু নাওয়া হলে পরে
আঁচল ছাঁকিয়া তারা ছোটো মাছ ধরে।
বালি দিয়ে মাজে থালা, ঘটিগুলি মাজে,
বধূরা কাপড় কেচে যায় গৃহকাজে।

আষাঢ়ে বাদল নামে, নদী ভর ভর
মাতিয়া ছুটিয়া চলে ধারা খরতর।
মহাবেগে কলকল কোলাহল ওঠে,
ঘোলা জলে পাকগুলি ঘুরে ঘুরে ছোটে।
দুই কূলে বনে বনে পড়ে যায় সাড়া,
বরষার উৎসবে জেগে ওঠে পাড়া।। 

 

গানের পারে

  দাঁড়িয়ে আছো তুমি আমার     গানের ও পারে।
আমার    সুরগুলি পায় চরণ, আমি     পাই নে তোমারে।
        বাতাস বহে মরি মরি,     আর বেঁধে রেখো না তরী,
        এসো এসো পার হয়ে মোর     হৃদয়-মাঝারে।।
        তোমার সাথে গানের খেলা     দূরের খেলা যে -
        বেদনাতে বাঁশি বাজায়     সকল বেলা যে।
        কবে নিয়ে আমার বাঁশি     বাজাবে গো আপনি আসি
        আনন্দময় নীরব রাতের     নিবিড় আঁধারে?।

 

ছয়

অতিথিবৎসল,
       ডেকে নাও পথের পথিককে
         তোমার আপন ঘরে,
           দাও ওর ভয় ভাঙিয়ে।
       ও থাকে প্রদোষের বস্‌তিতে,
       নিজের কালো ছায়া ওর সঙ্গে চলে
         কখনো সমুখে কখনো পিছনে,
       তাকেই সত্য ভেবে ওর যত দুঃখ যত ভয়।
       দ্বারে দাঁড়িয়ে তোমার আলো তুলে ধরো,
         ছায়া যাক মিলিয়ে,
             থেমে যাক ওর বুকের কাঁপন।

  বছরে বছরে ও গেছে চলে
        তোমার আঙিনার সামনে দিয়ে,
          সাহস পায় নি ভিতরে যেতে,
          ভয় হয়েছে পাছে ওর বাইরের ধন
                     হারায় সেখানে।
                 দেখিয়ে দাও ওর আপন বিশ্ব
                     তোমার মন্দিরে,
  সেখানে মুছে গেছে কাছের পরিচয়ের কালিমা,
     ঘুচে গেছে নিত্যব্যবহারের জীর্ণতা,
       তার চিরলাবণ্য হয়েছে পরিস্ফুট।

  পান্থশালায় ছিল ওর বাসা,
  বুকে আঁকড়ে ছিল তারই আসন, তারই শয্যা,
  পলে পলে যার ভাড়া জুগিয়ে দিন কাটালো
       কোন্‌ মুহূর্তে তাকে ছাড়বে ভয়ে
       আড়াল তুলেছে উপকরণের।
  একবার ঘরের অভয় স্বাদ পেতে দাও তাকে
                          বেড়ার বাইরে।

আপনাকে চেনার সময় পায় নি সে,
     ঢাকা ছিল মোটা মাটির পর্দায়;
  পর্দা খুলে দেখিয়ে দাও যে, সে আলো, সে আনন্দ,
         তোমারই সঙ্গে তার রূপের মিল।
     তোমার যজ্ঞের হোমাগ্নিতে
         তার জীবনের সুখদুঃখ আহুতি দাও,
            জ্বলে উঠুক তেজের শিখায়,
            ছাই হোক যা ছাই হবার।

       হে অতিথিবৎসল,
            পথের মানুষকে ডেকে নাও ঘরে,
            আপনি যে ছিল আপনার পর হয়ে
                   সে পাক্‌ আপনাকে। 

অনন্ত প্রেম

তোমারেই যেন ভালোবাসিয়াছি শত রূপে শতবার
জনমে জনমে যুগে যুগে অনিবার।
চিরকাল ধরে মুগ্ধ হৃদয় গাঁথিয়াছে গীতহার–
কত রূপ ধরে পরেছ গলায়, নিয়েছ সে উপহার
জনমে জনমে যুগে যুগে অনিবার।

যত শুনি সেই অতীত কাহিনী, প্রাচীন প্রেমের ব্যথা,
অতি পুরাতন বিরহমিলন কথা,
অসীম অতীতে চাহিতে চাহিতে দেখা দেয় অবশেষে
কালের তিমিররজনী ভেদিয়া তোমারি মুরতি এসে
চিরস্মৃতিময়ী ধ্র“বতারকার বেশে।

আমরা দুজনে ভাসিয়া এসেছি যুগলপ্রেমের স্রোতে
অনাদি কালের হৃদয়-উৎস হতে।
আমরা দুজনে করিয়াছি খেলা কোটি প্রেমিকের মাঝে
বিরহবিধুর নয়নসলিলে, মিলনমধুর লাজে–
পুরাতন প্রেম নিত্যনূতন সাজে।

আজি সেই চির-দিবসের প্রেম অবসান লভিয়াছে,
রাশি রাশি হয়ে তোমার পায়ের কাছে।
নিখিলের সুখ, নিখিলের দুখ, নিখিল প্রাণের প্রীতি,
একটি প্রেমের মাঝারে মিশেছে সকল প্রেমের স্মৃতি–
সকল কালের সকল কবির গীতি।

 

কাজী নজরুল ইসলাম-এর কবিতা




কবি-রাণী

তুমি আমায় ভালোবাসো তাই তো আমি কবি।
আমার এ রূপ-সে যে তোমায় ভালোবাসার ছবি।।
আপন জেনে হাত বাড়ালো-
আকাশ বাতাস প্রভাত-আলো,
বিদায়-বেলার সন্ধ্যা-তারা
পুবের অরুণ রবি,-
তুমি ভালোবাস ব’লে ভালোবাসে সবি?

আমার আমি লুকিয়েছিল তোমার ভালোবাসায়,
তুমিই আমার মাঝে আসি’
অসিতে মোর বাজাও বাঁশি,
আমার পূজার যা আয়োজন
তোমার প্রাণের হবি।
আমার বাণী জয়মাল্য, রাণি! তোমার সবি।।

তুমি আমায় ভালোবাস তাই তো আমি কবি।
আমার এ রূপ-সে যে তোমার ভালোবাসার ছবি।। 

 

 

সংকল্প

থাকব না কো বদ্ধ ঘরে, দেখব এবার জগৎটাকে,-
কেমন করে ঘুরছে মানুষ যুগান্তরের ঘুর্ণিপাকে।
দেশ হতে দেশ দেশান্তরে
ছুটছে তারা কেমন করে,
কিসের নেশায় কেমন করে মরছে যে বীর লাখে লাখে,
কিসের আশায় করছে তারা বরণ মরণ-যন্ত্রণারে।।

কেমন করে বীর ডুবুরী সিন্ধু সেঁচে মুক্তা আনে,
কেমন করে দুঃসাহসী চলছে উড়ে স্বরগ পানে।
জাপটে ধরে ঢেউয়ের ঝুঁটি
যুদ্ধ-জাহাজ চলছে ছুটি,
কেমন করে আঞ্ছে মানিক বোঝাই করে সিন্ধু-যানে,
কেমন জোরে টানলেসাগর উথলে ওঠে জোয়ার বানে।

কেমন করে মথলে পাথার লক্ষী ওঠেন পাতাল ফুঁড়ে,
কিসের অভিযানে মানুষ চলছে হিমালয় চুড়ে।
তুহিন মেরু পার হয়ে যায়
সন্ধানীরা কিসের আশায়;
হাউই চড়ে চায় যেতে কে চন্দ্রলোকের অচিন পুরেঃ
শুনবো আমি, ইঙ্গিত কোন 'মঙ্গল' হতে আসছে উড়ে।।

কোন বেদনার টিকিট কেটে চন্ডু-খোর এ চীনের জাতি
এমন করে উদয়-বেলায় মরণ-খেলায় ওঠল মাতি।
আয়ার্ল্যান্ড আজ কেমন করে
স্বাধীন হতে চলছে ওরেঃ
তুরষ্ক ভাই কেমন করে কাঁটল শিকল রাতারাতি!
কেমন করে মাঝ গগনে নিবল গ্রীসের সূর্য-বাতি।।

রইব না কো বদ্ধ খাঁচায়, দেখব এ-সব ভুবন ঘুরে-
আকাশ বাতাস চন্দ্র-তারায় সাগর-জলে পাহাড়-চুঁড়ে।
আমার সীমার বাঁধন টুটে
দশ দিকেতে পড়ব লুটেঃ
পাতাল ফেড়ে নামব নীচে, ওঠব আবার আকাশ ফুঁড়েঃ
বিশ্ব-জগৎ দেখব আমি আপন হাতের মুঠোয় পুরে।।

 

 


 


লিচু চোর

বাবুদের তাল-পুকুরে
হাবুদের ডাল-কুকুরে
সে কি বাস করলে তাড়া,
বলি থাম একটু দাড়া।

পুকুরের ঐ কাছে না
লিচুর এক গাছ আছে না
হোথা না আস্তে গিয়ে
য়্যাব্বড় কাস্তে নিয়ে
গাছে গো যেই চড়েছি
ছোট এক ডাল ধরেছি,

ও বাবা মড়াত করে
পড়েছি সরাত জোরে।
পড়বি পড় মালীর ঘাড়েই,
সে ছিল গাছের আড়েই।
ব্যাটা ভাই বড় নচ্ছার,
ধুমাধুম গোটা দুচ্চার
দিলে খুব কিল ও ঘুষি
একদম জোরসে ঠুসি।

আমিও বাগিয়ে থাপড়
দে হাওয়া চাপিয়ে কাপড়
লাফিয়ে ডিঙনু দেয়াল,
দেখি এক ভিটরে শেয়াল!

সেকি ভাই যায় রে ভুলা-
মালীর ঐ পিটুনিগুলা!
কি বলিস ফের হপ্তা!
তৌবা-নাক খপ্তা!

পথহারা

বেলা শেষে উদাস পথিক ভাবে,
সে যেন কোন অনেক দূরে যাবে -
উদাস পথিক ভাবে।

‘ঘরে এস’ সন্ধ্যা সবায় ডাকে,
‘নয় তোরে নয়’ বলে একা তাকে;
পথের পথিক পথেই বসে থাকে,
জানে না সে কে তাহারে চাবে।
উদাস পথিক ভাবে।

বনের ছায়া গভীর ভালোবেসে
আঁধার মাথায় দিগবধূদের কেশে,
ডাকতে বুঝি শ্যামল মেঘের দেশে
শৈলমূলে শৈলবালা নাবে -
উদাস পথিক ভাবে।

বাতি আনি রাতি আনার প্রীতি,
বধূর বুকে গোপন সুখের ভীতি,
বিজন ঘরে এখন সে গায় গীতি,
একলা থাকার গানখানি সে গাবে -
উদাস পথিক ভাবে।

হঠাত্‍ তাহার পথের রেখা হারায়
গহন বাঁধায় আঁধার-বাঁধা কারায়,
পথ-চাওয়া তার কাঁদে তারায় তারায়
আর কি পূবের পথের দেখা পাবে
উদাস পথিক ভাবে।





ছাত্রদলের গান

 আমরা শক্তি আমরা বল
                        আমরা ছাত্রদল।
মোদের পায়ের তলায় মূর্ছে তুফান
                        ঊর্ধ্বে বিমান ঝড়-বাদল।
                                আমরা ছাত্রদল।।

মোদের আঁধার রাতে বাধার পথে
                        যাত্রা নাঙ্গা পায়,
আমরা শক্ত মাটী রক্তে রাঙাই
                        বিষম চলার ঘাস।
                যুগে যুগে রক্তে মোদের
                        সিক্ত হ’ল পৃথ্বীতল।
                                 আমরা ছাত্রদল।।

মোদের কক্ষচ্যুত-ধূমকেতু-- প্রায়
                         লক্ষ্যহারা প্রাণ
আমরা ভাগ্যদেবীর  যজ্ঞবেদীর
                        নিত্য বলিদান।
যখন লক্ষ্মীদেবী  স্বর্গে উঠেন
                        আমরা পশি নীল অতল!
                                   আমরা ছাত্রদল।।

আমরা ধরি মৃত্যু রাজার
                        যজ্ঞ-ঘোড়ার রাশ,
মোদের মৃত্যু লেখে মোদের
                        জীবন--ইতিহাস!
            হাসির দেশে আমরা আনি
                        সর্বনাশী চোখের জল
                               আমরা ছাত্রদল।।

                সবাই যখন বুদ্ধি যোগায়
                        আমরা করি ভুল!
                সাবধানীরা বাঁধ বাঁধে সব,
                        আমরা ভাঙি কূল।
                দারুণ-রাতে আমরা তরুণ
                        রক্তে করি পথ পিছল!
                                   আমরা ছাত্রদল।।        

মোদের চক্ষে জ্বলে জ্ঞানের মশাল,
                        বক্ষে ভরা বাক্,
                কন্ঠে মোদের কুন্ঠাবিহীন
                        নিত্য কালের ডাক।
আমরা তাজা খুনে লাল ক’রেছি
                        সরস্বতীর শ্বেত কমল।
                                    আমরা ছাত্রদল।।        

ঐ দারুণ উপপ্লবের দিনে
                        আমরা দানি শির,
                মোদের মাঝে মুক্তি কাঁদে
                        বিংশ শতাব্দীর!
মোরা গৌরবেরি কান্না দিয়ে
                        ভ’রেছি মা’র শ্যাম-আঁচল।
                                আমরা ছাত্রদল।
                আমরা রচি ভালোবাসার
                        আশার ভবিষ্যৎ,
মোদের স্বর্গ-পথের অভাস দেখায়
                        আকাশ-ছায়াপথ!
                মোদের চোখে বিশ্ববাসীর
                        স্বপ্ন দেখা হোক সফল।
                                আমরা ছাত্রদল।।

 

 

নারী

  সাম্যের গান গাই
আমার চক্ষে পুরুষ-রমনী কোনো ভেদাভেদ নাই।
বিশ্বে যা-কিছু মহান্ সৃষ্টি চির-কল্যাণকর
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।
বিশ্বে যা-কিছু এল পাপ-তাপ বেদনা অশ্রুবারি
অর্ধেক তার আনিয়াছে নর, অর্ধেক তার নারী।
নরককুন্ড বলিয়া কে তোমা’ করে নারী হেয়-জ্ঞান?
তারে বল, আদি-পাপ নারী নহে, সে যে নর-শয়তান।
অথবা পাপ যে - শয়তান যে - নর নহে নারী নহে,
ক্লীব সে, তাই সে নর ও নারীতে সমান মিশিয়া রহে।
এ-বিশ্বে যত ফুটিয়াছে ফুল, ফলিয়াছে যত ফল,
নারী দিল তাহে রূপ-রস-মধু-গন্ধ সুনির্মল।
তাজমহলের পাথর দেখেছে, দেখিয়াছ তার প্রাণ?
অন্তরে তার মোমতাজ নারী, বাহিরেতে শা-জাহান।
জ্ঞানের লক্ষ্ণী, গানের লক্ষ্ণী, শস্য-লক্ষ্ণী নারী,
সুষমা-লক্ষ্ণী নারীই ফিরিছে রূপে রূপে সঞ্চারি’।
পুরুষ এনেছে দিবসের জ্বালা তপ্ত রৌদ্রদাহ,
কামিনী এনেছে যামিনী-শান্তি, সমীরণ, বারিবাহ।
দিবসে দিয়াছে শক্তি-সাহস, নিশীথে হয়েছে বধু,
পুরুষ এসেছে মরুতৃষা লয়ে, নারী যোগায়েছে মধু।
শস্যক্ষেত্র উর্বর হ’ল, পুরুষ চালাল হল,
নারী সে মাঠে শস্য রোপিয়া করিল সুশ্যামল।
নর বাহে হল, নারী বহে জল, সেই জল-মাটি মিশে’
ফসল হইয়া ফলিয়া উঠিল সোনালি ধানের শীষে।

    স্বর্ণ-রৌপ্যভার
নারীর অঙ্গ-পরশ লভিয়া হয়েছে অলঙ্কার।
নারীর বিরহে, নারীর মিলনে, নর পেল কবি-প্রাণ,
যত কথা তার হইল কবিতা, শব্দ হইল গান।
নর দিল ক্ষুধা, নারী দিল সুধা, সুধায় ক্ষুধায় মিলে’
জন্ম লভিছে মহামানবের মহাশিশু তিলে তিলে।
জগতের যত বড় বড় জয় বড় বড় অভিযান
মাতা ভগ্নী ও বধুদের ত্যাগে হইয়াছে মহীয়ান।
কোন্ রণে কত খুন দিল নর, লেখা আছে ইতিহাসে,
কত নারী দিল সিঁথির সিঁদুর, লেখা নাই তার পাশে।
কত মাতা দিল হৃদয় উপাড়ি’ কত বোন দিল সেবা,
বীরের স্মৃতি-স্তম্ভের গায়ে লিখিয়া রেখেছে কেবা?
কোন কালে একা হয়নি ক’ জয়ী পুরুষের তরবারি,
প্রেরণা দিয়াছে, শক্তি দিয়াছে বিজয়-লক্ষ্ণী নারী।
রাজা করিতেছে রাজ্য-শাসন, রাজারে শাসিছে রানী,
রানির দরদে ধুইয়া গিয়াছে রাজ্যের যত গ্লানি।

                                     পুরুষ হৃদয়হীন,
মানুষ করিতে নারী দিল তারে আধেক হৃদয় ঋণ।
ধরায় যাঁদের যশ ধরে না ক’ অমর মহামানব,
বরষে বরষে যাঁদের স্মরণে করি মোরা উৎসব।
খেয়ালের বশে তাঁদের জন্ম দিয়াছে বিলাসী পিতা।
লব-কুশে বনে তাজিয়াছে রাম, পালন করেছে সীতা।
নারী সে শিখাল শিশু-পুরুষেরে স্নেহ প্রেম দয়া মায়া,
দীপ্ত নয়নে পরাল কাজল বেদনার ঘন ছায়া।
অদ্ভূতরূপে পুরুষ পুরুষ করিল সে ঋণ শোধ,
বুকে করে তারে চুমিল যে, তারে করিল সে অবরোধ।

   তিনি নর-অবতার
পিতার আদেশে জননীরে যিনি কাটেন হানি’ কুঠার।
পার্শ্ব ফিরিয়া শুয়েছেন আজ অর্ধনারীশ্বর -
নারী চাপা ছিল এতদিন, আজ চাপা পড়িয়াছে নর।

  সে যুগ হয়েছে বাসি,
যে যুগে পুরুষ দাস ছিল না ক’, নারীরা আছিল দাসী।
বেদনার যুগ, মানুষের যুগ, সাম্যের যুগ আজি,
কেহ রহিবে না বন্দী কাহারও, উঠিছে ডঙ্কা বাজি’।
নর যদি রাখে নারীরে বন্দী, তবে এর পর যুগে
আপনারি রচা ঐ কারাগারে পুরুষ মরিবে ভুগে!

    যুগের ধর্ম এই-
পীড়ন করিলে সে পীড়ন এসে পীড়া দেবে তোমাকেই।

   শোনো মর্ত্যের জীব!
অন্যেরে যত করিবে পীড়ন, নিজে হবে তত ক্লীব!
স্বর্ণ-রৌপ্য অলঙ্কারের যক্ষপুরীতে নারী
করিল তোমায় বন্দিনী, বল, কোন্‌ সে অত্যাচারী?
আপনারে আজ প্রকাশের তব নাই সেই ব্যাকুলতা,
আজ তুমি ভীরু আড়ালে থাকিয়া নেপথ্যে কও কথা!
চোখে চোখে আজ চাহিতে পার না; হাতে রুলি, পায় মল,
মাথার ঘোম্‌টা ছিঁড়ে ফেল নারী, ভেঙে ফেল ও-শিকল!
যে ঘোমটা তোমা’ করিয়াছে ভীরু, ওড়াও সে আবরণ,
দূর করে দাও দাসীর চিহ্ন ঐ যত আভরণ!

   ধরার দুলালী মেয়ে,
ফির না তো আর গিরিদরীবনে পাখী-সনে গান গেয়ে।
কখন আসিল ‘প্নুটো’ যমরাজা নিশীথ-পাখায় উড়ে,
ধরিয়া তোমায় পুরিল তাহার আঁধার বিবর-পুরে!
সেই সে আদিম বন্ধন তব, সেই হতে আছ মরি’
মরণের পুরে; নামিল ধরায় সেইদিন বিভাবরী।
ভেঙে যমপুরী নাগিনীর মতো আয় মা পাতাল ফুঁড়ি!
আঁধারে তোমায় পথ দেখাবে মা তোমারি ভগ্ন চুড়ি!
পুরুষ-যমের ক্ষুধার কুকুর মুক্ত ও পদাঘাতে
লুটায়ে পড়িবে ও চরণ-তলে দলিত যমের সাথে!
এতদনি শুধু বিলালে অমৃত, আজ প্রয়োজন যবে,
যে-হাতে পিয়ালে অমৃত, সে-হাতে কূট বিষ দিতে হবে।
   সেদিন সুদূর নয়
যেদিন ধরণী পুরুষের সাথে গাহিবে নারীরও জয়!